লুপ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়ো, ক্যাম্পাস পুনরুদ্ধার করো!
এই প্রবন্ধে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে লুপ সংস্কৃতির উদ্ভব এবং তা কীভাবে ক্যাম্পাসের প্রগতিশীল আন্দোলন ও ছাত্র-সংগ্রামকে দুর্বল করে তোলে, তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
9/1/20251 মিনিট পড়ুন


আসক্তি এবং আসক্তি মূলক অভ্যাস দীর্ঘকাল ধরেই আমাদের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যে কারণেই মানুষ আসক্তির দ্বারস্থ হোক না কেন, সে প্রতিদিনের দুর্দশা থেকে পালানোর জন্য, কি পরিবার বা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার শূন্যতা পূরণের জন্য, অথবা স্রেফ আমেজের জন্য, এর প্রভাব সবসময়ই ক্ষতিকারক। যাদবপুরের সমাজের উন্নতির জন্য প্রগতিশীল সংগ্রামের ইতিহাস যত পুরনোই হোক না কেন, সেও এই মাড়ক থেকে নিস্তার পায়নি। নেশার চোটে ভালো-মন্দের মাথা খাওয়া, এবং অহং সন্তুষ্টির জন্য যেকোনো কাজকর্মে বাঁধা দেওয়া - সমাজব্যবস্থায় প্রগতিশীল কাজকর্মের জন্য ক্ষতিকারক।
নেশার "লুপ"এর এই আগুনে তেল দেয় দৈনন্দিন জীবনের হতাশা, যার কারণ খুঁজলে পাওয়া যাবে পূঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা, এবং স্তালিন বাদী সংগঠনগুলির সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শ্রেণী সচেতনতা ও বিপ্লবী মনোভাব তৈরি করার অক্ষমতা। পদ্ধতিগত ব্যর্থতা, এবং প্রগতিশীল সদস্যদের ঐক্যবদ্ধভাবে এই ধরণের সমস্যাগুলো সমাধানের অক্ষমতা, মিলিতভাবে এমন এক ইউনিয়ন তৈরী করে যা তার নিজের সদস্যদেরই প্রতিনিধিত্ব করে না। এরই চূড়ান্ত ফলাফলস্বরূপ, ছাত্রছাত্রীরা আসক্তির অবলম্বনে আত্ম-ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে, এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজকর্মে উপদ্রব হয়ে বসে। গত ২৫শে আগস্ট, ২০২৫ ফেটসু সাধারণ বৈঠকের (General Body Meeting) ঘটনাটিই এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ, যেখানে একজন চতুর্থ বছরের ছাত্র খুবই আপত্তিজনক এবং অযৌক্তিক এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় জিবির কাছে, যে, রাজ্যের এক মন্ত্রী একজন ছাত্রের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেওয়ার পর মিথ্যে অভিযোগে যারা পুলিশের হেফাজতে ছিল তাদের ইউনিয়নের কাজকর্মে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া উচিত কি না। একজন ছাত্র যে আগে এক স্তালিনবাদী সংগঠনের সদস্য ছিল, এখন সেই "লুপ"এর এক ঘনিষ্ঠ "লুম্পেন", তার এরকম অযৌক্তিক বক্তব্য পেশ করা এটাই বার বার প্রমাণ করে যে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ বা যুক্তি-তর্কের মধ্যে দিয়ে সচেতনতার উন্নয়নের অভাবই আমাদের সমাজে প্রতিক্রিয়াশীল অবনমনকারী শক্তির জন্ম দেয়। রাজনৈতিক মতাদর্শের অভাবের কথা উঠলে কালেকটিভের কথা উল্লেখ করতেই হয়। ২০২০ সালের ইউনিয়ন ইলেকশনের আগে ডিএসএফ প্যানেল মিটিংয়ে কালেকটিভের দেওয়া প্যানেলের বিরোধীতায় একজন জ্যেষ্ঠতম ডিএসএফ সদস্য যখন জানায় যে প্যানেলে উল্লিখিত একজনকে হোস্টেলে সারাক্ষণই নেশা করতে দেখা যায়, কালেকটিভ সদস্যরা সঙ্গে সঙ্গে মিটিংয়ে উপস্থিত বাকি ডিএসএফ সদস্যদের উপর যথারীতি চড়াও হয়, কিছু সদস্যরা আহত হয়, একজন তরুণ সদস্যের এপিলেপটিক শক পর্যন্ত হয় এবং তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়, যেই সময়ে কালেকটিভ কারোর সাথে কোনো আলোচনা ছাড়াই নিজেদের প্যানেল জমা দিয়ে দেয়। "নেশা" এবং "লুপ" কে কালেকটিভ সবসময় ব্যবহার করেছে প্রথম-দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের দলে টানার জন্য, এবং কালেকটিভ এর মত অরাজনৈতিক, মতাদর্শ হীন, গুন্ডা-মনোভাবের একটি অ-সংগঠনের কাছে নেশা শুধু প্রয়োজনীয়ই নয়, নেশা রীতিমত তাদের কাজ করার উপায়!
এইভাবেই, এই ধরণের "লুপ"গুলোকে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন গণসংগঠন অপব্যবহার করে গেছে, মিছিলে মাথা বাড়ানোর জন্য একত্রিত করেছে, আর নিজের সংগঠনে সদস্য নিয়োগের জন্য ব্যবহার করেছে।
"The traditions of all dead generations weigh like a nightmare on the brains of the living"
- The Eighteenth Brumaire of Louis Bonaparte, Karl Marx
("মৃত প্রজন্মদের ঐতিহ্য জীবিতদের মস্তিষ্কে দুঃস্বপ্নের মত বোঝা হয়ে থাকে"
- The Eighteenth Brumaire of Louis Bonaparte, Karl Marx)
আমাদের আগে যারা ছিল, তাদের ভুলভ্রান্তি আমরা বোঝা হিসেবে বয়ে চলি। ইউনিয়নের বিভিন্ন কার্যকলাপ, সাংস্কৃতিক উৎসব, নবীনবরণ, ইত্যাদিতে এইসব গোষ্ঠীদের প্রচুর অংশগ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে। এভাবেই দেখা যাচ্ছে ক্যাম্পাসের কাজকর্মে আমাদের প্রত্যক্ষ প্রভাব সরে যাচ্ছে, এবং "লুপ" একটা স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে ক্যাম্পাসে আরো দৃঢ় ও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এইসব গোষ্ঠীরা ক্যাম্পাসে লোকজনের সাথে বসা-আড্ডা ইত্যাদি ইত্যাদি করে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করছে এবং নিজেদেরকে ক্যাম্পাসে বজায়ও রাখছে। কেউ কেউ হয়তো মনে করতে পারে যে এদের সাথে সহাবস্থান করাই যায়, কিন্তু তার পিছনের কারণটাও বুঝতে পারা দরকার। সহাবস্থান করা আদপে এইসব সুবিধাবাদী সংগঠনগুলোকেই সাহায্য করে; তারা এইসব লুপে তাদের নিজেদের সদস্যদের স্থাপন করে রাখে, এতে এইসব সংগঠনগুলো যেকোনো দরকারে জড়ো করার জন্য সহজে লোক পেয়ে যায়।
আমাদের কর্তব্য সুস্পষ্ট। এই চক্রটাকে আমাদের ভাঙতে হবে, ছাত্রছাত্রীদের এই বিষাক্ত লুপের লোপাটে পড়তে দেওয়া যাবে না, এবং সেটা আমাদেরকে সংগ্রামী ঐক্যতান ও কাজকর্মে স্পষ্টতার মধ্যে দিয়েই করতে হবে। দিনবদলের সংগ্রামে সম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণ দ্বারাই ছাত্রছাত্রীদের সমষ্টিগত সচেতনতার উন্নয়ন সম্ভব।